রোহিঙ্গা শিবিরে ইংরেজি, বার্মিজ ভাষা ছাড়া বাংলা পাঠদান সরকারিভাবে অবৈধ ও নিষিদ্ধ সত্ত্বেও স্থানীয় কিছু ব্যক্তি ও এনজিওর সহায়তায় কৌশলে বাংলা শিখছে রোহিঙ্গা শিশুরা। শুধু রোহিঙ্গা শিশুরাই নয়, বাংলা শেখার প্রতি আগ্রহ বেড়েছে তরুণ, মধ্য বয়স্ক বা বয়স্কদের মধ্যেও।

গোপনে বাংলা ভাষা শেখার বিষয়টিকে নিরাপত্তার জন্য হুমকি মনে করছেন আন্তর্জাতিক, নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও স্থানীয় প্রশাসন। এই কাজে রোহিঙ্গা শিশুদের সহায়তা করছে কিছু এনজিও ও প্রত্যাবাসন চক্র। স্থানীয় প্রশাসন বলছেন, এ রকম সংবাদ আমাদের কাছেও আছে। খুব শিগগির আমরা এর বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে যাব। যারা সহায়তা করেছে তাদেরকেও আইনি ব্যবস্থায় আনা হবে।

শবনম বেবী একজন রোহিঙ্গা নারী। কক্সবাজারের টেকনাফ শামলাপুর ২৩নং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বসবাস ছিল তার পরিবারের। মিয়ানমার থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেছে এমনটা দাবি তার। রোহিঙ্গা ব্লক মাঝি ইউনুছের মেয়ে শবনম জীববিজ্ঞানে চট্টগ্রাম এশিয়ান ইউনিভার্সিটিতে পড়ালেখা করছে বলে জানা গেছে। ইউএনএইচসিআরের মাধ্যমে বাংলাদেশে পড়ালেখা করার সুযোগ পেয়েছে শবনম। জীববিজ্ঞানে ভর্তি হয়ে পড়ালেখা চালিয়ে যাচ্ছে বেবী। অন্য প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও রোহিঙ্গাদের বহু সন্তান লেখাপড়া করছে। উখিয়া ও টেকনাফের রোহিঙ্গা বসতির বিভিন্ন ক্যাম্প ঘুরে ও স্থানীয়দের সাথে কথা বলে এ তথ্য জানা গেছে।

সূত্র জানায়, বাংলাদেশি নাগরিক দাবি করে কক্সবাজারে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন লক্ষাধিক রোহিঙ্গা। ভবিষ্যতে কোথাও চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হলে, এদেশের নাগরিক প্রমাণ করতে তারা বাংলা ভাষায় পড়ালেখা করছেন। কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া পুরনো রোহিঙ্গা সন্তানের দেখাদেখিতে বাংলা শিক্ষার দিকে ঝুঁকছেন আশ্রয় ক্যাম্পে থাকা সাধারণ রোহিঙ্গারা।

ইতিপূর্বে কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ালেখা করে রোহিঙ্গা সন্তানরা উচ্চ শিক্ষা অর্জন করেছে। ওই সার্টিফিকেট দেখিয়ে নিজেদের বাংলাদেশি দাবি করছে তারা। প্রমাণস্বরূপ প্রশাসন ও সংশ্লিষ্টদের ভোটার তালিকায় তাদের নাম অন্তর্ভুক্ত, এনআইডি ও তাদের পিতা-মাতার নামে বাংলাদেশে ক্রয়কৃত জমির খতিয়ান প্রদর্শন করে চলেছেন। এনআইডি, জমির দলিল-খতিয়ান, স্কুল-কলেজ ও মাদ্রাসার সনদ দেখে কেউ রোহিঙ্গাদের বিদেশি নাগরিক বলতে পারছেন না। এ কারণে রোহিঙ্গা শিবিরে প্রকাশ্যে পড়ানো হচ্ছে বাংলা পাঠ্যবই। এনজিওগুলো রোহিঙ্গা শিশুদের আশ্রয় ক্যাম্পের লার্নিং সেন্টারগুলোতে বাংলায় শিক্ষাদান করছে।

একাধিক বেসরকারি সংস্থার গবেষণায় দেখা গেছে, ১৯৭৮, ১৯৯১-৯২ সালে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের অনেক সন্তান বাংলা শিক্ষায় শিক্ষিত। কেউ কেউ কওমি মাদ্রাসায় পড়ালেখা করেছে। কেউ কেউ কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত পড়াশোনা করছে। ওইসব প্রতিষ্ঠান থেকে বাংলাদেশি শিক্ষার্থী হিসেবে তারা সার্টিফিকেটও পেয়েছে। পুরনো রোহিঙ্গাদের দেখাদেখিতে বর্তমানে আশ্রিত রোহিঙ্গা অভিভাবকরাও তাদের সন্তানদের বাংলাদেশি নাগরিক বানাতে বাংলা পাঠ্যবই শিক্ষা দিতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন। আর কিছুসংখ্যক অতি উৎসাহী এনজিও রোহিঙ্গাদের ক্যাম্পে তাদের সন্তানদের বাংলা পাঠ্যবই সরবরাহ ও শিক্ষা দিচ্ছে। ওইসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ইংরেজি ও বার্মিজ ভাষায় শিক্ষিত প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগদানের নিয়ম থাকলেও, তারা গোপনে বাংলা পাঠ্যবই শিক্ষা দিতেও কর্মী নিয়োগ দিয়েছে।

একাধিক সূত্রে জানা গেছে, কক্সবাজার, উখিয়া, মহেশখালী, চকরিয়া, পেকুয়া, কুতুবদিয়া, চকরিয়া, রামু, টেকনাফ ও চট্টগ্রামের বিভিন্ন আরবি, বাংলা, ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয়েছে শত শত রোহিঙ্গা শিশু-কিশোর। ক্যাম্পে আশ্রিত অভিভাবকরা কৌশলে কক্সবাজার জেলাসহ দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি করিয়েছে তাদের সন্তানদের। নূরানি মাদ্রাসা ও লার্নিং সেন্টার থেকে প্রাথমিক শিক্ষা নিয়ে ভর্তি হচ্ছে দাখিল মাদ্রাসা ও স্কুল-কলেজে। পরিচয় গোপন রেখে ক্রমান্বয়ে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়েও পড়ছে বহু রোহিঙ্গা সন্তান। পুরনো রোহিঙ্গা নেতা ইদ্রিছ জিহাদী, শাইখ ছালামত উল্লাহ, মৌলবি রহিম উল্লাহসহ কয়েকজন রোহিঙ্গা নেতার ইন্ধনে বাংলা শিক্ষার দিকে আগ্রহ বাড়ছে রোহিঙ্গাদের।

সূত্র আরো জানায়, সশস্ত্র আরসা ক্যাডারদের ইন্ধনে মিয়ানমারের সামরিক শাসকের ওপর বিশ্বাস ও ভরসা করতে পারছেন না উখিয়া, টেকনাফে আশ্রিত রোহিঙ্গারা। ফলে বাংলাদেশে স্থায়ীভাবে বসবাস করার মতো চিন্তা-ভাবনা করে তাদের পরিচয় গোপন রেখে কৌশলে ছেলেমেয়েদের বাংলা শিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তোলার কলাকৌশল চালিয়ে যাচ্ছেন।

এ বিষয়ে রোহিঙ্গা প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি মাহবুবুর রহমান জানান, রোহিঙ্গা শিশুরা বাংলা শিখছে, এটি আমাদের জন্য আরো একটি দুঃসংবাদ। কারণ এই বাংলা শিখার পাশাপাশি তারা স্থানীয়দের সাথে সহজে মিশে যেতে পারবে। এক পর্যায়ে দেখা যাবে তারা উচ্চ শিক্ষার জন্য দেশের বিভিন্ন কলেজ বা ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনা করার সুযোগ পাচ্ছে।

অনেকেই ব্যক্তিগত পর্যায়ে বাংলাদেশিদের সহায়তায় বাংলা লেখাপড়া করছে বলেও জানা গেছে। কক্সবাজারের বিভিন্ন গ্যারেজে চাকরি করা রোহিঙ্গা তরুণরা নাম প্রকাশ না করে জানান, রোহিঙ্গা শিশুরা বাংলাদেশিদের সহায়তায় বাংলা বর্ণ ও অক্ষর শিখছে। তাদের লিখতে ও পড়তে ভালো লাগছে বলেও জানান তিনি।

নিরাপত্তা বিশ্লেষক অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল মনিরুজ্জামান বলেন, মিয়ানমারের নাগরিক রোহিঙ্গাদের সাময়িক আশ্রয় দেওয়া হয়েছে। তাদের লেখাপড়ার দায়িত্ব আমাদের নয়। এমনিতেই মিয়ানমার সরকার তাদের নাগরিক হিসেবে মানতে চায় না। এরপর যদি রোহিঙ্গারা বাংলা শেখে, তাহলে সে সুযোগ নেবে মিয়ানমার। নীতিগতভাবেই তাদের বাংলা মাধ্যমে লেখাপড়া করান যাবে না। বাংলা ভাষা-সংস্কৃতি তাদের শেখানোর সুযোগ নেই। যদি কেউ তাদের পড়াতে চায়, তাহলে রোহিঙ্গাদের মাতৃভাষা শেখাতে হবে।

রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকা উখিয়ার পালংখালী ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান এম গফুর উদ্দিন চৌধুরী জানান, রোহিঙ্গাদের বাংলা শিক্ষার ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ বিরত রাখতে হবে। যেসব এনজিও এসব কাজে জড়িত সরকারের উচিত তাদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়া।

কক্সবাজারের স্থানীয় এক ব্যক্তি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, মাদ্রাসায় ভর্তি হতে কোনো কিছুর দরকার হয় না। তাই তারা মাদ্রাসায় আরবি ও বাংলা লেখাপড়া শিখছে।

তবে এসব অভিযোগের বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এখনো কিছু জানে না। কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (মাদ্রাসা) রওনক মাহমুদ বলেন, স্কুল-মাদ্রাসায় কোনোভাবেই রোহিঙ্গা শিশুদের ভর্তি করার কথা নয়। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে সংশ্লিষ্ট মাদ্রাসার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।